`অতীব গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় পরিচয়পত্র` অধ্যক্ষ আসাদুল হক

যে কোনো দেশেই জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ এবং স্পর্শকাতর বিষয়। কারণ এই পরিচয়পত্র একজন মানুষের জন্মসূত্রে বা অনুমোদন সূত্রে নাগরিকত্বের পরিচয়ই শুধু দেয় না, রাষ্ট্রের নানাবিধ সুযোগ-সুবিধা এবং নিরাপত্তা দানের বিষয়, এমনকি বিদেশে কোনো সংকটে পড়লে সে সংকট উত্তরণে রাষ্ট্র প্রয়োজনীয় সহায়তাও দিয়ে থাকে। জাতীয় পরিচয়পত্র একজন নাগরিককে দেশ-পরিচয়ের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতিপত্র ও নাগরিক প্রমাণপত্র হিসেবে বিবেচিত হয়। সে জন্যে নাগরিকসাধারণকে জাতীয় পরিচয়পত্র প্রদানের আগে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি সত্যিকার অর্থে রাষ্ট্রের নাগরিক কিনা সে বিষয়ে যথেষ্ট অনুসন্ধান চালানো হয়। গোয়েন্দা সংস্থা মারফত খোঁজখবর নেওয়া হয় নানা বিষয়ে। সবকিছু ইতিবাচক বিবেচিত হলেই কেবল একজন মানুষকে নাগরিকত্বের সনদ দেওয়া হয়, যা জাতীয় পরিচয়পত্র হিসেবে পরিচিত। আবার জাতীয় পরিচয়পত্র হারিয়ে গেলে নতুন কার্ড উত্তোলনের সময় থানায় জিডি করা সহ কিছু প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয়। পৃথিবীর সব দেশেই এমনটি হয়। বাংলাদেশেও নাগরিকত্বের নানা তথ্য-প্রমাণ বিশ্লেষণ সাপেক্ষে জাতীয় পরিচয়পত্র দেওয়া হয়। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে জাতীয় পরিচয়পত্রকে ঘিরে গড়ে উঠেছে শক্তিশালী দালালচক্র। অর্থের বিনিময়ে এনআইডি সংশোধন, হারানো কার্ড উত্তোলন ও স্থানান্তরের কার্যক্রম করছে চক্রটি। খবরটি চরম উদ্বেগকর।

পত্রিকায় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, রাজধানী ঢাকার আগারগাঁওয়ের ইসলামিক ফাউন্ডেশন ভবনে অবস্থিত জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের (এনআইডি) বেশ ক’জন অসাধু কর্মকর্তার সঙ্গে যোগসাজশ রয়েছে অশুভ সিন্ডিকেটের। দেশের বিভিন্নস্থানে জেলা-উপজেলা কর্মকর্তারাও নাকি এর সঙ্গে যোগ দিয়েছেন। প্রকাশিত সংবাদে দেখা যায়, দালালচক্র প্রবাসী অথবা বিদেশগামী ‘পার্টি’র খোঁজ পেলেই নানা অজুহাতে হয়রানি করছে। মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে গোপনে ইসির সার্ভার থেকে জাতীয় পরিচয়পত্রের যে কোন ধরনের সেবা দিচ্ছে। দিনকয়েক আগে এ ধরনের পাঁচ দালালকে র‌্যাব গ্রেফতার করেছে।

এনআইডির মহাপরিচালকও জাতীয় পরিচয়পত্র বাণিজ্যের সঙ্গে কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংশ্লিষ্টতার কথা স্বীকার করেছেন। তিনি সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, ওই কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নজরদারিতে রাখা হয়েছে। যারা এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত তাদের খুঁজে বের করা হবে। যারা দালালদের মাধ্যমে অর্থের বিনিময়ে জাতীয় পরিচয়পত্র সেবা নিয়েছে তাদের পরিচয়পত্র পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে নেয়া হবে বলেও তিনি জানিয়েছেন। দালালচক্রের অপতৎপরতা দমনে এ ধরনের পদক্ষেপ নিশ্চয়ই ভালো ফল দেবে। তবে, জাতীয় পরিচয়পত্র উত্তোলন ও সংশোধনে জনভোগান্তির নিরসন এবং যারা এই অপকর্মের সঙ্গে যুক্ত তাদের আটক করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা ও যুৎসই প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করা না গেলে কাক্সিক্ষত ফল আসবে না।
[X]

উল্লেখ্য, ২০০৮ খ্রিস্টাব্দে ছবিসহ ভোটার তালিকা প্রণয়নের সাথেই দেয়া হয় জাতীয় পরিচয়পত্র। এই পরিচয়পত্র ভোটারের চিহ্ন বহন করলেও এখন জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার হচ্ছে জাতীয় জীবনের নানা প্রয়োজনে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি, পাসপোর্ট, মোবাইল সিম ক্রয়, ব্যাংক একাউন্ট খোলা, ব্যবসায়িক নিবন্ধনসহ গুরুত্বপূর্ণ সব কাজে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে জাতীয় পরিচয়পত্র। এনআইডির ভোটার তালিকা হালনাগাদে প্রতিবারই তথ্য সংগ্রহের সময় উভয়পক্ষের গাফিলতির কারণে তথ্যের গরমিল থাকছে। এসব ক্ষেত্রে নামের বানান, ঠিকানা, জন্ম তারিখ, পিতা-মাতার নামের বানান নির্ভুল করা যায়নি। মাঠ পর্যায়ের অনিয়ম পর্যবেক্ষণ করে ভোটার তথ্য সংগ্রহ ফরমে পিতা-মাতার নাম ও বর্তমান ঠিকানা ভুল করা এবং আইডি নম্বরের ঘর খালি রাখা, শনাক্তকারীর স্বাক্ষর না থাকা, সুপারভাইজার ও যাচাইকারীর নাম ও স্বাক্ষর না থাকা, এইচএসসি পাস হওয়া সত্ত্বেও স্বাক্ষর না নিয়ে শুধু টিপসই নেয়া, আঙ্গুলের অস্পষ্ট ছাপ, ইংরেজি ও বাংলা বানানে অসামঞ্জস্য প্রভৃতি ২১টি সমস্যা চিহ্নিত করা হয়। দায়ী মাঠকর্মীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশও করা হয়। তবে এখনও পর্যন্ত কারো বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।

জাতীয় পরিচয়পত্র উত্তোলন ও সংশোধনে জনহয়রানি ও জনভোগান্তির খবর বেশ কিছুদিন আগে থেকেই সংবাদমাধ্যমে আসছে। কিন্তু এ বিষয়ে কোনো ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণের খবর জানা যায় নি। এতে সুযোগ নিচ্ছে দালালরা। আমরা মনে করি, এ ধরনের জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর বিষয়ে দালালচক্রের অপতৎপরতা বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের বিকল্প নেই। সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগে ঘাপটি মেরে থাকা অসাধু চক্রকেও চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনা জরুরি। অন্যথায় জাতীয় পরিচয়পত্রের অবৈধ বাণিজ্য রোধ করা কঠিন হবে। একই সঙ্গে এ বিষয়ে জনসচেতনতাও বাড়াতে হবে। এ জন্যে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণার উদ্যোগ নিতে হবে।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর